দুর্গাপূজাঃ হিন্দু ধর্মীয়দের মহোৎসব

দুর্গাপূজার মূল গল্পটি হিন্দু পুরাণের অংশ, যেখানে মহিষাসুর নামের এক শক্তিশালি আসুর তার সাধনা ও প্রার্থনার মাধ্যমে আমরত্বের বর লাভ করে। দেব-দেবতার তার অত্যাচারে দিশেহারা হয়ে যান এবং সবাই মিলে দেবী দুর্গার সৃষ্টি করেন। দেবী দুর্গা দশ হাতে বিভিন্ন অস্ত্র ধারন করে মহিষাসুরকে বধ করেন। এই কাহিনির ভিত্তিতে দুর্গাপূজার মূল ভাবনা দাড়িয়ে আছে; "ধর্মের জয় এবং অধর্মের বিনাশ"। প্রতীক অর্থে, এই পূজা মানব জীবনে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির বিজয়কে স্মরণ করে। 

দুর্গাপূজার আয়োজন শুরু হয় পূজার কয়েক মাস আগে থেকেই। মৃৎশিল্পীর দেবী দুর্গার মূর্তি তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। মাটি, বাঁশ, কাঠের ফ্রেম ব্যবহার করে সাবধানে প্রতিমা গড়া হয়। প্রতিমা গড়ার জন্য প্রথাগত নিয়ম অনুসারে গঙ্গার মাটি ও পূজার উপযোগী পবিত্র মাটি ব্যবহার করা হয়। প্রতিমার মুখ ও দেহের কারুকাজে শিল্পীরা তাদের দক্ষতার পরিচয় দেন। 

প্রতিমার পাশাপাশি মণ্ডপ তৈরির কাজও শুরু হয়। মণ্ডপগুলি সাধারনত থিমভিত্তিক হয় এবং তা দেখতে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমায়। প্যান্ডেল বা মণ্ডপ সাজানো হয় বিভিন্ন থিমের উপর ভিত্তি করে, যা কখনো ঐতিহাসিক, কখনো আধুনিক বা কখনো শুধুমাত্র সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্য তৈরি করা হয়। 

দুর্গাপূজা মূলত ষষ্ঠী, সপ্তমি, অষ্টমী, নবমি এবং দশমী, এই পাঁচদিন ধরে চলে। ষষ্ঠীর দিন দেবীর "বোধন" অর্থাৎ দেবীর আগমন হয়, এবং সপ্তমীর দিন পূজার মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়। অষ্টমী তিথিতে কুমারি পূজা এবং সন্ধি পূজা গুরুত্বপূর্ণ আচার হিসাবে পালন করা হয়। সন্ধি পূজা হলো এক বিশেষ সময়ের পূজা,  যা অষ্টমী এবং নবমী তিথির সন্ধিক্ষণে করা হয়। নবমী তিথিতে হোমযঙ্গের মাধ্যমে পূজা শেষ হয়।

দশমী হলো বিসর্জনের দিন। এই দিন দেবীকে গঙ্গায় বা নিকটবর্তী নদিতে বিসর্জন দেওয়া হয়। দশমীর দিন মানুষ দেবীকে বিদায় জানিয়ে একে অপরের সঙ্গে শারদীয় সুভেচ্ছা বিনিময় করেন। বাংলায় হিন্দু সমাজে বিজয়া দশমীর দিন একে অপরকে মিষ্টিমুখ করানো এবং শুভেচ্ছা জানানো এক গুরুত্বপূর্ণ রীতি। 

আরো পড়ুন ঃ হিন্দু ধর্মের উৎপত্তি ও তার ইতিহাস ,

দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়, এটি বাঙালি সমাজে এক বৃহত্তর সাংস্কৃতিক মিলনমেলারও প্রতীক। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে এই সময়ে সবাই একসঙ্গে আনন্দ উপভোগ করে। পূজা উপলক্ষে বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং বিনোদনমূলক কার্যক্রম আয়োজিত হয়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গান, নাচ, নাটক, কবিতা আবৃতি প্রভৃতি পরিবেশিত হয়।

দুর্গাপূজার সময়ে প্রতিটি বাঙালির মনেই এক ধরনের উন্মাদনা কাজ করে। নতুন পোশাক পরা, মণ্ডপে ঘোড়া। পূজার প্রসাদ গ্রহন করা এবং সন্ধ্যায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান করা, সবকিছু মিলিয়ে উৎসবের আনন্দ বহুগুনে বৃদ্ধি পায়। দুর্গাপূজা এমন একটি উৎসব, যা মানুষকে আনন্দ এবং সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ করে। 

দুর্গাপূজা শুধু ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, অর্থনৈতিকভাবেও এটি একটি বিশাল ভূমিকা পালন করে। পূজার সময় বিভিন্ন শিল্পকর্মী, মৃৎশিল্পী, কারিগর, দোকানদার, পোশাক ব্যবসায়ী, রেস্তোরাঁ মালিকদের ব্যস্ততা বেড়ে যায়। পূজার সময়ে বিপুল পরিমান অর্থের লেনদেন হয়, যা স্থানীয় অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। বিশেষ করে মৃৎশিল্পীদের জন্য এটি তাদের জীবিকা নির্বাহের অন্যতম মৌসুম। 

দুর্গাপূজা উদযাপনের সঙ্গে পরিবেশগত দিকগুলিও জড়িত। প্রতিমা বিসর্জনের সময় নদী এবং জলাশয়গুলোতে দূষণ সৃষ্টি হয়। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিবেশবান্ধব উপায়ে প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। মাটি, পাট এবং জৈব পদার্থ থেকে তৈরি প্রতিমা পরিবেশের প্রতি দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করতে সহায়ক। এছাড়াও, কিছু এলাকায় জলাশয়ের পরিবর্তে নির্দিষ্ট জায়গায় প্রতিমা বিসর্জন দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

দুর্গাপূজা বাঙালি সাংস্কৃতিক একটি অনন্য পরিচয়, যা সমাজে ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক একতা ও মিলনের বার্তা বহন করে। এটি শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান নয়, বরং বাঙালি জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। পূজার এই উৎসব আমাদের সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহ্যকে চিরকাল অমর করে রাখবে, সেই সঙ্গে নতুন প্রজন্মের কাছেও এর গুরুত্ব ও তাৎপর্য তুলে ধরবে।