গুনাহ মাফের জন্য সর্বোত্তম ৫টি দোয়া

ইসলামিক দৃষ্টিতে সফল জীবনের সংজ্ঞা: দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য পথনির্দেশ মানুষ জন্মগতভাবে ভুল-ত্রুটির অধিকারী। দৈনন্দিন জীবনে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অসংখ্য গুনাহ করে ফেলি। আর এই গুনাহ যদি আল্লাহর কাছে ক্ষমা না চাই, তাহলে পরকালীন জীবনে কঠিন শাস্তির সম্মুখীন হতে হতে পারি। তবে আশার কথা হলো — আল্লাহ তায়ালা তাঁর বান্দাদের গুনাহ মাফ করতে ভালোবাসেন। তিনি বলেছেন, যে তাওবা করে, তার সব গুনাহ তিনি ক্ষমা করে দেন।

আজকের এই আর্টিকেলে আমরা জানব গুনাহ মাফের জন্য সর্বোত্তম ৫টি দোয়া, যা হাদিসে প্রমাণিত ও প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজেও বেশি বেশি পড়তেন। এই দোয়াগুলোর ফজিলত ও অর্থসহ জানলে হৃদয় নরম হয়ে আসবে। আর দুনিয়া ও আখেরাতের মুক্তির আশায় সবাই এগুলো মুখস্থ করে পড়া শুরু করতে পারবে। চলুন জেনে নিই গুনাহ মাফের সেরা এই ৫টি দোয়া।

সাইয়্যিদুল ইসতিগফার (সর্বোত্তম ক্ষমা প্রার্থনার দোয়া)

পাপমুক্ত জীবন আমাদের প্রত্যেকের কাম্য। প্রতিদিন ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় আমরা ছোট-বড় অনেক গুনাহ করে ফেলি। আর এই গুনাহ মাফের জন্য যে দোয়াটি সবচেয়ে উত্তম ও মর্যাদাপূর্ণ, সেটি হলো সাইয়্যিদুল ইসতিগফার।

এই দোয়াটি প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) নিজে পড়তেন এবং উম্মতকে বেশি বেশি পড়ার জন্য উৎসাহিত করতেন। হাদিসে বলা হয়েছে,

“যে ব্যক্তি সকালবেলা এই দোয়া পড়বে এবং ঐ দিন মারা গেলে, সে জান্নাতী হবে। আর সন্ধ্যায় পড়লে এবং ঐ রাতে মারা গেলে, সেও জান্নাতী হবে।”

(সহীহ বুখারী: ৬৩০৬)

দোয়াটি নিচে দেয়া হলো:

আরবি:

اللَّهُمَّ أَنْتَ رَبِّي لَا إِلٰهَ إِلَّا أَنْتَ، خَلَقْتَنِي وَأَنَا عَبْدُكَ، وَأَنَا عَلٰى عَهْدِكَ وَوَعْدِكَ مَا اسْتَطَعْتُ، أَعُوذُ بِكَ مِنْ شَرِّ مَا صَنَعْتُ، أَبُوءُ لَكَ بِنِعْمَتِكَ عَلَيَّ، وَأَبُوءُ بِذَنْبِي، فَاغْفِرْ لِي، فَإِنَّهُ لَا يَغْفِرُ الذُّنُوبَ إِلَّا أَنْتَ।

বাংলা উচ্চারণ:

আল্লাহুম্মা আনতা রাব্বী, লা ইলাহা ইল্লা আনতা, খালাকতানী ওয়া আনা আবদুকা, ওয়া আনা আলা আহদিকা ওয়া ওয়াদিকা মাস্তাতও’তু, আউযু বিকা মিন শাররি মা সানাতু, আবূউ লাকা বি নি’মাতিকা আলাইয়া, ওয়া আবূউ বি জানবী, ফাগফিরলী, ফাইন্নাহু লা ইয়াগফিরুয-যুনুবা ইল্লা আনতা।

বাংলা অর্থ:

“হে আল্লাহ! আপনিই আমার পালনকর্তা। আপনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। আপনিই আমাকে সৃষ্টি করেছেন। আমি আপনার বান্দা। আমি আমার সাধ্য অনুযায়ী আপনার প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকারের ওপর অটল থাকার চেষ্টা করছি। আমি আমার কৃতকর্মের অনিষ্ট থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাই। আপনি আমাকে যেসব নেয়ামত দিয়েছেন, আমি তা স্বীকার করছি এবং আমার গুনাহের কথাও স্বীকার করছি। অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয়ই আপনি ছাড়া আর কেউ গুনাহ ক্ষমা করতে পারে না।”

সাইয়্যিদুল ইসতিগফারের ফজিলত:

• এই দোয়া দিনে-রাতে একবার পড়া জান্নাতের কারণ।
• এটি গুনাহ মাফের সবচেয়ে শক্তিশালী দোয়া।
• অন্তর থেকে কান্নাকাটি করে পড়লে আল্লাহ অবশ্যই মাফ করবেন।

কখন পড়তে হবে:

• সকাল বেলা ফজরের পর
• সন্ধ্যায় মাগরিবের পর
• কিংবা সুযোগ পেলেই

উপদেশ:

এই দোয়াটি মুখস্থ করে রাখুন। প্রতিদিন সকালে ও রাতে পড়ুন। এটি শুধু দুনিয়ার জন্য নয় — পরকালীন মুক্তির সবচেয়ে বড় হাতিয়ার।

আরো পড়ুনঃ নামাজ না পড়লে যে ৭টি ক্ষতি হয় — জানলে শিউরে উঠবেন!

গুনাহ মাফের সংক্ষিপ্ত ও শক্তিশালী দোয়া

১. আস্তাগফিরুল্লাহ

আরবি: أَسْتَغْفِرُ اللّٰهَ

বাংলা অর্থ: আমি আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।

ফজিলত:

নবীজি (সা.) নিজে দিনে ৭০-১০০ বার এই দোয়া পড়তেন। ছোট্ট এই দোয়াটি গুনাহ মাফের জন্য অত্যন্ত শক্তিশালী।

২. আল্লাহুম্মাগফিরলি

আরবি: اللّٰهُمَّ اغْفِرْ لِي

বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ! আমাকে ক্ষমা করুন।

ফজিলত:

যেকোনো সময় এই দোয়া পড়া যায়। মন চাইলেই পড়ে ফেলুন, আল্লাহ খুশি হবেন।

৩. রাব্ব্বিগফিরলি ওয়ারহামনি

আরবি: رَبِّ اغْفِرْ لِيْ وَارْحَمْنِيْ

বাংলা অর্থ: হে আমার প্রতিপালক! আমাকে মাফ করুন এবং আমার প্রতি দয়া করুন।

৪. আল্লাহুম্মা ইন্নাকা আফুউন, তুহিব্বুল আফওয়া, ফাআফু আননি

আরবি:

اللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ، تُحِبُّ الْعَفْوَ، فَاعْفُ عَنِّي

বাংলা অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি ক্ষমাকারী। আপনি ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। অতএব, আমাকে ক্ষমা করুন।

ফজিলত:

বিশেষ করে রমজানের শেষ দশকে এই দোয়া বেশি বেশি পড়তে বলা হয়েছে।

৫. লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ্জালিমিন

আরবি:

لَا إِلٰهَ إِلَّا أَنْتَ سُبْحَانَكَ، إِنِّي كُنْتُ مِنَ الظَّالِمِينَ

বাংলা অর্থ: আপনি ছাড়া আর কোনো ইলাহ নেই। আপনি পবিত্র, নিঃসন্দেহে আমি ছিলাম জালিম।

ফজিলত:

ইউনুস (আ.) মাছের পেটে এই দোয়া পড়েছিলেন। যে কেউ গুনাহ মাফ চেয়ে এই দোয়া পড়লে আল্লাহ তার ডাকে সাড়া দেন।

এই সংক্ষিপ্ত অথচ শক্তিশালী দোয়াগুলো বেশি বেশি পড়লে গুনাহ মাফ তো হবেই, সঙ্গে অন্তরে প্রশান্তি আসবে এবং আল্লাহর কাছে আরও বেশি কাছাকাছি হওয়া যাবে। এই দোয়াগুলো প্রতিদিনের জীবনে অভ্যাস করে ফেলুন।

নবিজির শিক্ষা দেওয়া তওবার দোয়া

দারুণ অনুরোধ করেছো শাব্বির! প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) আমাদের জন্য যেসব তওবার দোয়া শিখিয়ে গেছেন, তার মধ্যে অন্যতম একটি দোয়া হলো — যা তিনি নিজে পড়তেন এবং উম্মতকে শিখিয়েছেন। আমি তোমাকে সেটাই সুন্দরভাবে আরবি, উচ্চারণ, অর্থ এবং ফজিলতসহ দিয়ে দিলাম:

নবিজির শিক্ষা দেওয়া তওবার দোয়া

আরবি:

اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي، وَتُبْ عَلَيَّ، إِنَّكَ أَنْتَ التَّوَّابُ الرَّحِيمُ

বাংলা উচ্চারণ:

আল্লাহুম্মাগফিরলী, ওয়া তুব আলাইয়্যা, ইন্নাকা আনতাত্তাওওয়াবুর রহীম।

বাংলা অর্থ:

হে আল্লাহ! আমাকে মাফ করে দিন এবং আমার তওবা কবুল করুন। নিশ্চয় আপনি তাওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।

ফজিলত:

নবীজি (সা.) এই দোয়াটি বেশি বেশি পড়তেন। হাদিসে এসেছে, তিনি দিনে-রাতে ৭০ থেকে ১০০ বার পর্যন্ত আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতেন এবং তওবা করতেন। এ দোয়াটি খুবই সহজ, তবে অত্যন্ত শক্তিশালী।

তুমি যখন গুনাহ করে ফেলো বা মনে মনে অনুতপ্ত হও, তখন এ দোয়াটি পড়ে ফেলো। আল্লাহ কবুল করবেন ইনশাআল্লাহ।

আরো পড়ুনঃ সকালে ওঠার সময় এই দোয়াটি পড়লে সারাদিন ভালো যায়

জান্নাত লাভ ও গুনাহ মাফের দোয়া

আরবি:

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ الْجَنَّةَ وَمَا قَرَّبَ إِلَيْهَا مِنْ قَوْلٍ وَعَمَلٍ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ النَّارِ وَمَا قَرَّبَ إِلَيْهَا مِنْ قَوْلٍ وَعَمَلٍ

বাংলা উচ্চারণ:

আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকাল জান্নাতা ওয়া মা কাররাবা ইলাইহা মিন কাওলিঁওঁ ওয়া আমালিন, ওয়া আউযুবিকা মিনান্নারি ওয়া মা কাররাবা ইলাইহা মিন কাওলিঁওঁ ওয়া আমালিন।

বাংলা অর্থ:

হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে জান্নাত প্রার্থনা করছি এবং জান্নাতের দিকে নিয়ে যায় এমন কথা ও কাজের তাওফিক চাই। আর জাহান্নাম থেকে আপনার কাছে আশ্রয় চাই এবং সে সব কথা ও কাজ থেকেও, যা মানুষকে জাহান্নামের দিকে টেনে নেয়।

ফজিলত:

• এই দোয়া জান্নাত লাভের জন্য অত্যন্ত মূল্যবান।
• গুনাহ মাফ এবং নেক আমলের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাওয়ার পূর্ণ দোয়াও এটাতে আছে।
• হাদিসে এসেছে, নবীজি (সা.) সাহাবিদের এ দোয়া বেশি বেশি পড়তে বলেছেন।

কিয়ামতের ভয় ও গুনাহ মোচনের দোয়া

আরবি:

اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِي ذَنْبِي كُلَّهُ، دِقَّهُ وَجِلَّهُ، وَأَوَّلَهُ وَآخِرَهُ، وَعَلاَنِيَتَهُ وَسِرَّهُ

বাংলা উচ্চারণ:

আল্লাহুম্মাগফিরলী জানবি কুল্লাহু, দিক্ব্বাহু ওয়া জিল্লাহু, ওয়া আওয়ালাহু ওয়া আখিরাহু, ওয়া আলানিয়াতাহু ওয়া সিররাহু।

বাংলা অর্থ:

হে আল্লাহ! আপনি আমার সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিন — ছোট হোক বা বড়, প্রকাশ্য হোক বা গোপন, পূর্বের হোক বা পরের।

আরেকটি কিয়ামতের ভয় ও জান্নাতের প্রার্থনার দোয়া:

আরবি:

اللَّهُمَّ أَجِرْنِي مِنَ النَّارِ

বাংলা উচ্চারণ:

আল্লাহুম্মা আজিরনী মিনান্নার।

বাংলা অর্থ:

হে আল্লাহ! আমাকে দোযখের আগুন থেকে রক্ষা করুন।

ফজিলত:

• কিয়ামতের ভয়ে নবীজি (সা.) এই দোয়া বেশি পড়তেন
• সাহাবিদেরও এ দোয়া বেশি পড়তে বলতেন।
• রমজানের শেষ দশকে এই দোয়া বেশি বেশি পড়া উত্তম।

এই দোয়াগুলো হৃদয় থেকে পড়লে, কিয়ামতের ভয় সহজ হবে এবং গুনাহ মাফের আশ্বাসও পাওয়া যাবে। আল্লাহ আমাদের সবাইকে কবুল করুন।

শেষকথাঃ উপসংহার

প্রিয় পাঠক, আমরা সকলেই জানি—পৃথিবীতে বসবাস করা অবস্থায় মানুষ কখনো না কখনো ভুল-ত্রুটিতে লিপ্ত হয়। কিন্তু আল্লাহর রহমত এতটাই অবারিত যে, তিনি তার বান্দাদের ক্ষমা করতে ভালোবাসেন। বিশেষ করে যে বান্দা অন্তর থেকে অনুতপ্ত হয়ে, চোখের পানি ফেলে তওবা করে, তার গুনাহ আল্লাহ অবশ্যই মাফ করেন।

উপরের উল্লিখিত এই ৫টি দোয়া আমাদের জীবনে নিত্যদিনের সঙ্গী করা উচিত। কারণ এগুলো শুধু গুনাহ মোচনের মাধ্যমই নয়, বরং জান্নাতের পথকেও প্রশস্ত করে দেয়। কিয়ামতের ভয়, দুনিয়ার বিপদ থেকে নিরাপত্তা এবং পরকালের মুক্তির জন্য এসব দোয়ার কোনো বিকল্প নেই।

আসুন আমরা সবাই আল্লাহর কাছে বেশি বেশি ক্ষমা চাই, এই দোয়াগুলো হৃদয়ে ধারণ করি এবং নেক আমল করতে মনোযোগী হই। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিন এবং জান্নাতের সর্বোচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।

এই লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না, কারণ একটি দোয়া শিখিয়ে দেওয়া মানে অশেষ সওয়াব অর্জন করা।